পিত্রালয়
দেবাশিষ রায়
ছাত্রাবস্থা শেষ হইবার পূর্বেই, বহুদূরে চাকুরী পাইয়া পিত্রালয় ত্যাগ করিতে হইয়াছিল। ফিরিতাম যখন ছুটিছাটায়, পথ আর ফুরাইত না। বহুদূর হইতে ট্রেনের দরজায় দাঁড়াইয়া ভাবিতাম আর কত দূর। গৃহে প্রবেশ করিবা মাত্র আদর আপ্যায়নে ভাসিয়া যাইতাম। মনে হইত পূর্বে কেন এইরূপ যত্ন পাই নাই। চাকুরী পাইয়াছি বলিয়া? প্রয়োজনের অংশীদার হইয়াছি বলিয়া ? সেইরূপ কখনো মনে হয় নাই। মনে হইত বহুদূর হইতে সন্তান বহুদিন পর গৃহে ফিরিয়াছে বলিয়া এইরূপ স্নেহ বর্ষিত হইতেছে। ফিরিবার কালে জননীর অঝোর কান্নায় প্রচণ্ড বিব্রত হইতাম, ব্যথায় মন ভরিয়া যাইত। ভাবিতাম, ইহাদের এত কষ্ট দিয়া আমি নিজের ভালোর জন্য ইহাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছি। কিন্তু ভুল ভাঙিল অচিরেই। এক বৎসর ছয় মাস চাকুরী করিবার পরে মনে হইলো, আমি চাকুরী করিবার জন্য এই ধরাধামে আসি নাই। চিত্ত বড়ই অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। স্বভাব বাউণ্ডুলে আমি চাকুরী করিতে গিয়া বাঁধা-ধরা জীবনে হাঁপাইয়া উঠিলাম। গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া ঘোষণা করিলাম, আমি আর চাকুরী করিব না। ফিরিব না আর চাকুরী স্থলে। তোমাদের কষ্ট দিয়া, কাঁদাইয়া আমি আর ফিরিয়া যাইব না। দেখিলাম, গৃহে এক গুমোট আবহাওয়ার সৃষ্টি হইল। আমার চাকুরী করা বা না করা লইয়া অতো চিন্তা না হইলেও, চিন্তাগ্রস্ত হইলো সবাই এমন কী ব্যাপার ঘটিল। প্রথম আশঙ্কা বুঝিলাম, প্রেমিকার চাপে এই সিদ্ধান্ত লইয়াছি কি না। উহা অমূলক বুঝিয়া পরবর্তী আশঙ্কা দেখিলাম, চাকুরীস্থলে কিছু হয় নাই তো ? এক মাস পরে অফিস হইতে সত্বর যোগদান করিবার টেলিগ্রাম আসিবার পর উহাও ঘুচিল। তাহার পর শুরু হইলো সেই চিরন্তন ভাবনা, এই ছেলের কী হইবে গো ? কানাঘুসায় বুঝিলাম গৃহে সবাই একমত যে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকারময়, আমার দ্বারা কিছু হইবে না, ভবিষ্যতে এ ছেলে সবার বোঝা হইয়া দাঁড়াইবে। শুনিয়া বড় ব্যথিত হইলাম। বিশেষ করিয়া আমার দ্বারা কিছু হইবে না শুনিয়া। তখন বুঝি নাই, এ বড় চিরন্তন ধারণা। বিবাহ পরবর্তী কালে গৃহিণীর মুখ হইতে বারংবার ইহা শুনিয়া, ইহার অসারতা উপলব্ধি করিয়াছি। যাহা হউক, আমার এই কথা তাহার বহুদিন পূর্বের। তখন, এই কিছু হইবে না শুনিয়া মন স্থির করিলাম, চাকুরী স্থলে ফিরিয়া গিয়া আমার প্রিয়জনেদের ধারণা কতখানি ভ্রান্ত তাহা প্রমাণ করিতে হইবে। অতএব ৪৮ দিন পরে ফিরিয়াছিলাম সেই দূরবর্তী চাকুরীস্থলে। মনে হইল, ইহাই আমার আপন স্থান। বিবাহিতা মহিলাদের পিতৃগৃহ-গমনও খানিকটা এইরূপ বলিয়া মনে হয়। দুই চার দিনের জন্য যাইলে আদর যত্নের অভাব নাই। ফিরিবার কালে পিতার ছলছল চক্ষু, মাতার ক্রন্দন, বউদির মুখে আঁচল চাপিয়া বেদনা প্রদর্শন কালে মনে হইতেই পারে ইহাদের কষ্ট দিয়া কেন যাইতেছি? থাকিয়া যাই না কেন আরও কিছুদিন। তাহাও হয়ত সবাই মানিয়া লইতে পারে। কিন্তু শুনিতে হইতে পারে, থাকবি যে, জামাই বাবাজীবনের কষ্ট হইবে না? রাগিয়া যাইবে না তো ? কিন্তু যদি কেহ কহেন, আমি আর ফিরিয়া যাইব না তোমাদের ছাড়িয়া। তখন? তখন আমি যাহা যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম, ঠিক তাহারই পুনরাবৃত্তি হইবে। কী হইলো? জামাই এর সহিত বিরোধ না কি শ্বশুরালয়ের কারো সহিত ? কী করিয়া আসিয়াছে শ্বশুরালয়ে ? সারা জীবনের জন্য বোঝা হইবে না কি? পিতৃ-সম্পত্তির ভাগ লইবার মতলব আঁটিয়াছে না কি? ভ্রাত্রবধূর রাত্রের ঘুম চলিয়া যাইবে। কথায় কথায় ভাই রাগিয়া উঠিবে। মাতা রাত্রি কালে মাথায় হাত বুলাইয়া বোঝাইবেন, মাথা ঠাণ্ডা করিতে। বিবাহের পরে শ্বশুরালয়ই মহিলাদের আসল গৃহ। দিনমানে পিতা শুকনো মুখে বিচরণ করিবেন, কী করিবেন? কোন পক্ষ লইবেন? এইরূপ পরিবেশ দেখিতে দেখিতে একদিন মনে হইবে, ফিরিয়া যাই। শ্বশুরালয় বা পতি গৃহে ফিরিয়া আসিবার পর দেখিবেন, মনে হইবে, সত্যি, ইহাই আমার আপন স্থান।
ছাত্রাবস্থা শেষ হইবার পূর্বেই, বহুদূরে চাকুরী পাইয়া পিত্রালয় ত্যাগ করিতে হইয়াছিল। ফিরিতাম যখন ছুটিছাটায়, পথ আর ফুরাইত না। বহুদূর হইতে ট্রেনের দরজায় দাঁড়াইয়া ভাবিতাম আর কত দূর। গৃহে প্রবেশ করিবা মাত্র আদর আপ্যায়নে ভাসিয়া যাইতাম। মনে হইত পূর্বে কেন এইরূপ যত্ন পাই নাই। চাকুরী পাইয়াছি বলিয়া? প্রয়োজনের অংশীদার হইয়াছি বলিয়া ? সেইরূপ কখনো মনে হয় নাই। মনে হইত বহুদূর হইতে সন্তান বহুদিন পর গৃহে ফিরিয়াছে বলিয়া এইরূপ স্নেহ বর্ষিত হইতেছে। ফিরিবার কালে জননীর অঝোর কান্নায় প্রচণ্ড বিব্রত হইতাম, ব্যথায় মন ভরিয়া যাইত। ভাবিতাম, ইহাদের এত কষ্ট দিয়া আমি নিজের ভালোর জন্য ইহাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছি। কিন্তু ভুল ভাঙিল অচিরেই। এক বৎসর ছয় মাস চাকুরী করিবার পরে মনে হইলো, আমি চাকুরী করিবার জন্য এই ধরাধামে আসি নাই। চিত্ত বড়ই অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। স্বভাব বাউণ্ডুলে আমি চাকুরী করিতে গিয়া বাঁধা-ধরা জীবনে হাঁপাইয়া উঠিলাম। গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া ঘোষণা করিলাম, আমি আর চাকুরী করিব না। ফিরিব না আর চাকুরী স্থলে। তোমাদের কষ্ট দিয়া, কাঁদাইয়া আমি আর ফিরিয়া যাইব না। দেখিলাম, গৃহে এক গুমোট আবহাওয়ার সৃষ্টি হইল। আমার চাকুরী করা বা না করা লইয়া অতো চিন্তা না হইলেও, চিন্তাগ্রস্ত হইলো সবাই এমন কী ব্যাপার ঘটিল। প্রথম আশঙ্কা বুঝিলাম, প্রেমিকার চাপে এই সিদ্ধান্ত লইয়াছি কি না। উহা অমূলক বুঝিয়া পরবর্তী আশঙ্কা দেখিলাম, চাকুরীস্থলে কিছু হয় নাই তো ? এক মাস পরে অফিস হইতে সত্বর যোগদান করিবার টেলিগ্রাম আসিবার পর উহাও ঘুচিল। তাহার পর শুরু হইলো সেই চিরন্তন ভাবনা, এই ছেলের কী হইবে গো ? কানাঘুসায় বুঝিলাম গৃহে সবাই একমত যে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকারময়, আমার দ্বারা কিছু হইবে না, ভবিষ্যতে এ ছেলে সবার বোঝা হইয়া দাঁড়াইবে। শুনিয়া বড় ব্যথিত হইলাম। বিশেষ করিয়া আমার দ্বারা কিছু হইবে না শুনিয়া। তখন বুঝি নাই, এ বড় চিরন্তন ধারণা। বিবাহ পরবর্তী কালে গৃহিণীর মুখ হইতে বারংবার ইহা শুনিয়া, ইহার অসারতা উপলব্ধি করিয়াছি। যাহা হউক, আমার এই কথা তাহার বহুদিন পূর্বের। তখন, এই কিছু হইবে না শুনিয়া মন স্থির করিলাম, চাকুরী স্থলে ফিরিয়া গিয়া আমার প্রিয়জনেদের ধারণা কতখানি ভ্রান্ত তাহা প্রমাণ করিতে হইবে। অতএব ৪৮ দিন পরে ফিরিয়াছিলাম সেই দূরবর্তী চাকুরীস্থলে। মনে হইল, ইহাই আমার আপন স্থান। বিবাহিতা মহিলাদের পিতৃগৃহ-গমনও খানিকটা এইরূপ বলিয়া মনে হয়। দুই চার দিনের জন্য যাইলে আদর যত্নের অভাব নাই। ফিরিবার কালে পিতার ছলছল চক্ষু, মাতার ক্রন্দন, বউদির মুখে আঁচল চাপিয়া বেদনা প্রদর্শন কালে মনে হইতেই পারে ইহাদের কষ্ট দিয়া কেন যাইতেছি? থাকিয়া যাই না কেন আরও কিছুদিন। তাহাও হয়ত সবাই মানিয়া লইতে পারে। কিন্তু শুনিতে হইতে পারে, থাকবি যে, জামাই বাবাজীবনের কষ্ট হইবে না? রাগিয়া যাইবে না তো ? কিন্তু যদি কেহ কহেন, আমি আর ফিরিয়া যাইব না তোমাদের ছাড়িয়া। তখন? তখন আমি যাহা যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলাম, ঠিক তাহারই পুনরাবৃত্তি হইবে। কী হইলো? জামাই এর সহিত বিরোধ না কি শ্বশুরালয়ের কারো সহিত ? কী করিয়া আসিয়াছে শ্বশুরালয়ে ? সারা জীবনের জন্য বোঝা হইবে না কি? পিতৃ-সম্পত্তির ভাগ লইবার মতলব আঁটিয়াছে না কি? ভ্রাত্রবধূর রাত্রের ঘুম চলিয়া যাইবে। কথায় কথায় ভাই রাগিয়া উঠিবে। মাতা রাত্রি কালে মাথায় হাত বুলাইয়া বোঝাইবেন, মাথা ঠাণ্ডা করিতে। বিবাহের পরে শ্বশুরালয়ই মহিলাদের আসল গৃহ। দিনমানে পিতা শুকনো মুখে বিচরণ করিবেন, কী করিবেন? কোন পক্ষ লইবেন? এইরূপ পরিবেশ দেখিতে দেখিতে একদিন মনে হইবে, ফিরিয়া যাই। শ্বশুরালয় বা পতি গৃহে ফিরিয়া আসিবার পর দেখিবেন, মনে হইবে, সত্যি, ইহাই আমার আপন স্থান।
বি.দ্রঃ -- পরীক্ষা
প্রার্থনীয়
0 মতামত:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন