ইশারায়
দেবাশিস
ঘোষ
সমীর প্রত্যাখ্যাত হয়নি মোটেও ।
তবু ফিরে আসতে হল তাকে । তন্দ্রা আপত্তি তো করেনি বটেই , দৃশ্যত বরং সম্মতিই জানিয়েছিল ।
অতটা ভাবতেই পারেনি সমীর , আশা
করা তো দূরের কথা । হবে নাই বা কেন , অনেকেরই আগ্রহ তাকে নিয়ে । উজ্জ্বলতায় তারা কেউ কম নয়
সমীরের থেকে । অন্যদিকে নিজে সে লাজুক প্রকৃতির , ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াবার
শক্তি বা সাহস কোনোটাই তার ছিল না । তাছাড়া ইউনিভার্সিটিতে তন্দ্রার সিনিয়র ছিল সে
। সহপাঠীদের ভিড়ের মধ্যেই সারাদিন আটকা পড়ে থাকত যে , তার দিকে সে এগোবে কেমন করে ? খুব কাছে গিয়ে কথা বলবার সুযোগ
একমাত্র লাইব্রেরিতে । কিন্তু লাইব্রেরিতেই বা আর নিভৃতি কোথায় ! সেখানেও ভিড় ।
সে ভিড় মনোযোগী পাঠকের , সেখানে
নৈকট্যের সূচনা করার সামান্যতম প্রয়াসও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু । বইপত্র আশ্রয় করে
যেটুকু কথা বলার সম্ভাব্য সুযোগ , তা
বড় সামান্য সময়ের । নইলে শুধু দূরের থেকে দেখা ।
প্রস্তাব যেদিন জানাল সেদিন সে একলা ছিল । কপালে না থাকলে এমনটা হয় না ।
ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে দেখা হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ । ইউনিভার্সিটির পাট তারও চুকে
গেছে সমীরের মতন । তবু হয়তো দরকার পডেছিল কোনো , যেমন হঠাৎ সমীরের পড়েছে ।
সেদিন গ্রীষ্মের
ভরদুপুরের খরতাপে কেমন করে যেন হঠাৎ সাহস জেগে উঠেছিল সমীরের । হয়তো কারণ ছিল তার , যে কারণে আপাত প্রতিকূলতার মাঝে
অনুকূল এক আবহাওয়া দেখা দিয়েছিল । দেখা হওয়া মাত্র হাসির সাথে সাথে যেভাবে চোখমুখ
উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তন্দ্রার , তা
বানান করে পড়লে অভ্যর্থনার নীরব উচ্চারণ শোনা যায় । বিনা রিহার্সালেই সমীর তখন
জিজ্ঞেস করতে পারল , চললে
কোথায় ? বাড়ি
?
নাকি কোনো দরকারি কাজে ?
-- দরকারি কাজের ডাক পাইনি এখনো । অগত্যা তাই বাড়ির দিকেই ।
তুমি?
-- তথৈবচ । কিন্তু আমার কোনো আফসোস নেই তার জন্য । এমন আড্ডা
মেরে সময় কাটানোর সুযোগ পরে আর কখনো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে । তাই আফসোস করে সময়টা নষ্ট করতে
সায় পাই না মনের । তোমায় কি এখনই ফিরতে হবে বাড়িতে ?
-- না , না
,
মোটেই না । এমন আশা
জাগানো কথা শোনার পর আর কখনো হতাশায় ছটফট করার জন্য বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবি ? কক্ষনো না । তা , তোমার আড্ডা দেওয়ার পরিকল্পনা এখন
কোথায় ? অন্য
কারো সাথে ?
-- একদম নয় । যাকে পাব তার সাথেই ।
-- ওহ্ , ফাইন
,
তাহলে আমাকে তো পেলেই ।
-- অবশ্যই , এর
চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে ?
-- ওহ্ , তাই!
আমি
ভাবতেও পারিনি এত বড় একটা কমপ্লিমেন্ট পাব তোমার কাছ থেকে ।
-- থ্যাংকস , চলো কোথায় যাবে ?
সমীর তখন অনুকূল
আবহাওয়ায় প্রাণপূর্ণ । বলল , আগে
তো চলা শুরু হোক , তারপর
না হয় ভাবা যাবে গন্তব্যের কথা । যেতে যেতে সমীরের মনে হল মাত্র ক’হাত দূরেই তো
কফি হাউস , আড্ডা
মারার পক্ষে সেটাই তো প্রকৃষ্ট জায়গা। সে কথা কি অজানা থাকতে পারে তন্দ্রার । তবু
কেন গন্তব্যের কথা জানতে চাইল সে । সে কি তবে চাইছে না কফি হাউসের ওই ভিড়-কোলাহলের
মধ্যে তাদের আড্ডার উদযাপন হারিয়ে যাক । সে কি তবে তেমনই নিভৃতি চাইছে যার জন্য
তার নিজের আকাঙ্ক্ষা প্রবল !
হাটতে হাটতে হঠাৎ তার
মনে হল এই মহার্ঘ সময় মৌনতায় নষ্ট করবার নয় । ঠিক তখনই এক প্রগলভ সমীর ফিরে এল তার
মধ্যে । সে বলল , জানো
তন্দ্রা , অনেক
দিন ধরে একটা কথা তোমায় বলবার কথা ভাবছি , কিন্তু কোনোদিন সুযোগ পেলাম না ।
তন্দ্রা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মুখের দিকে তাকাল । সমীর বলল , আজ এইভাবে হঠাৎ দেখা না হয়ে গেলে
কোনোদিনও সে
কথা বলা হত কিনা কে জানে । তন্দ্রা আর একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল । সমীরও তাকাল ।
তন্দ্রার ভ্রূ কি একটু কোঁচকানো ? চোখে
কি সন্দেহ ? নাকি
নিজের অনুমান অব্যর্থ বুঝতে পেরে কৌতুক প্রকাশ করেছে সন্দেহের ভঙ্গিতে ? । না , তা তো নয় , দৃষ্টি যেন কেমন মেদুর হয়ে আসছে
মেঘে ঢাকা আকাশের মতন ! যেন বলছে , সে কথা শোনার জন্য আমিও তো কান পেতে আছি কবে থেকে , তবে আর দেরি কেন ? । সমীরের মনে হল দ্বিতীয় অনুমানটাই
বোধহয় সত্য । তাই সে বলল , বলব
বলব , আছি
তো আমরা কিছুক্ষণ !
এগিয়ে গেল অনেক দূর , নিভৃতির খোঁজে । পাওয়া গেল শেষে
তেমন একটা জায়গা , ভর
দুপুরেও যেখানে ভিড় হয় না । সমীর এগিয়ে গেল কেবিনের দিকে । তন্দ্রা আপত্তি করল না
। সেও গেল পিছু পিছু । প্রায় ঘেমে নেয়ে ওঠা শরীরটা ফ্যানের হাওয়া পাওয়া মাত্রই
আরামে মুখ থেকে বেরিয়ে এল , " আহ্
" । আরামে তন্দ্রারও প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া , কিন্তু কোনো রকম উচ্চারণে তা
প্রকাশ পেল না । তন্দ্রা বলল , এবার
বলো কী বলতে চেয়েছিলে । সমীর বলল , বলব বলব , কোন ব্যস্ততা নেই । আগে বল , কী খাবে । তন্দ্রা বলল , শুধু চা , এই গরমে আবার কিছু খেতে আছে নাকি ?
-- গরমের কথা যদি বল, তাহলে কিন্তু চা-ও চলে না ।
তন্দ্রা চোখ তুলে তাকাল
সমীরের চোখের দিকে । ঐ ভাবেই থাকল কিছুক্ষণ দৃষ্টি দুজনের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ।
ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর কৌতুক খেলে গেল তন্দ্রার চোখে । সে বলল, অনেকক্ষণ থাকতে হলে কেবল চা-ই খেতে
হয় বারবার সেটা আজও বুঝতে পারনি সমীরদা ? কোনো খাবার অতক্ষণ সময় ধরে খাওয়া
যায় না ।
-- তা জানি , কিন্তু খাবার অর্ডার দেওয়ার যে আর
একটা লাভ আছে , সেটা
তুমি জান না ।
-- জানি না হয়তো , কিন্তু অনুমান করতে পারি , ঠিক যেমন অনুমান করতে পারি তুমি কী
বলবে , মানে
কোন কথা বলবার জন্য সময় নিচ্ছ ।
-- কী কথা বলো তো ? দেখি তোমার অনুমান কতটা ঠিক হয় ।
-- অনুমান করা মোটেই কঠিন
নয় , সমীরদা
। অনেক আগেই তুমি যে তা বলে দিয়েছ , তুমি তা জান না । আমার শুধু একটাই সন্দেহ ছিল যে ঠিক
শুনেছি কিনা । তো আজ যখন তুমি এত আয়োজন করছ সে কথা বলবার জন্য , তখন আর বুঝতে বাকি থাকে নাকি যে
কথাটা আমি ঠিকই শুনেছিলাম ।
সমীর আবার জিজ্ঞেস করল , বেশ তো , শুনিই না কী অনুমান করলে ? । ঠিক সেই সময়ই বেয়ারা এসে হাজির
হল মেনু কার্ড নিয়ে , তন্দ্রা
উত্তর দেওয়ার আগেই । সমীর কার্ডটা এগিয়ে দিল তন্দ্রার দিকে । বলল , দেখ । দেখে বলো কোনটা চলবে ।
তন্দ্রা হাসল , বলল
,
তোমায় তো বললাম সমীরদা , আমার শুধু চা । সমীর বলল , হ্যাঁ তা শুনেছি তখন । দাও এদিকে , আমিই দেখি । তারপর নিজে দেখে
অর্ডার দিল সমীর । ফিশ কবিরাজি আর হার্ড টোস্ট , দুই জায়গায় । তারপর মেনু কার্ড
ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল , দুটোই
একসাথে দেবেন । একটু ভাল করে করবেন কিন্তু । বেয়ারা ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল ।
তারপর কেবিনের পর্দা টেনে দিতে দিতে বলল , একটু দেরি হবে কিন্তু । সমীর বলল , তা হোক । বেয়ারা চলে গেল । যাওয়ার
সময় আরো টান টান করে দিয়ে গেল পর্দাটা ।
সমীরের চোখ যখন সেখান
থেকে সরে এসে তন্দ্রার মুখের উপর , তখন দেখল তন্দ্রা হাসছে । হালকা একটা হাসির ছোপ পড়ল
সমীরের ঠোঁটে । ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল , হাসছ যে ? । তন্দ্রা বলল , আমার অনুমান খুব একটা ভুল হয় না
দেখলাম । দেখলে তো আমি ঠিকই ধরেছিলাম , পর্দা টেনে কেমন ঢেকে দিয়ে গেল । কি , তাইতো ?
লজ্জা পাওয়া মুখে সমীর
বলল ,বাদ
দাওতো , বলো
কী বলছিলে তখন ? ।
তন্দ্রা বলল , আমি
কেন ? বলবে
তো তুমি । তখন বললে না কী একটা কথা তুমি অনেক দিন ধরে বলব বলব করছ । এখন বলে ফেল , এইতো প্রকৃষ্ট সময় । অলমোস্ট
নির্জন রেস্টুরেন্ট , কেবিন
পর্দায় ঢাকা । কি সমীরদা , আমার
অনুমান ঠিক আছে তো ? তোমার
এতদিনের অপেক্ষা এবার শেষ করে ফেলো ।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল
সমীরের চোখমুখ । দিশাহারা মনে হতে থাকল তার নিজেকে , সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন এলে
যেমন হয় । না ঠিক তাও নয় , সম্ভাব্য
যে প্রশ্নের উত্তর মনের মধ্যে তৈরি আছে , সে প্রশ্নের সমস্ত উত্তর বলে দিয়েও যদি আবার সেই প্রশ্নই
করা হয় , তাহলে
যেমন ভেবে পাওয়া যায় না আর কী বলার থাকতে পারে , অনেকটা সেই রকম ।
তার এই বিপর্যস্ত
অবস্থা দেখে তন্দ্রা জিজ্ঞেস করল , তোমার যে কেন এত দ্বিধা বুঝতে পারি
না । কত কেউ তো
বলে গেল এ যাবৎ , কম
শুনলাম নাকি সে কথা । কান ঝালাপালা হয়ে গেছে শুনতে শুনতে । বুঝতে পারি না ওই
কণ্ঠস্বরের ভিড়ে সেই চেনা কণ্ঠস্বরটা আছে কিনা যার জন্যে কান পেতে আছি । খুঁজে পাই
না কিছুতেই । অথচ নিয়ত সবাই বলে চলেছে , ভালবাসি , ভালবাসি , ভালবাসি । দুদিন আলাপ হতে না হতেই , কথাবার্তায় একটু সহজ হতে না হতেই ওই
এক কথা , ভালবাসি
। গলাটা তখন এমন গম্ভীর হয়ে যায় আর কথায় তখন এমন বিষাদের সুর থাকে যে মনে হয় যেন
মা বাবার মৃত্যুর খবর শোনাচ্ছে । শুনলে নিজের মনটাও যেন কেমন নরম হয়ে যায় , কোলে টেনে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে
। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে
,
আহা বাছা রে এত দুঃখ কীসের
তোর ? ভালবাসতে
ইচ্ছে করেছে ? তা
বাসবি, কে
বাধা দিচ্ছে তোকে ! শুধু হঠাৎ করে কোনোদিন বলতে আসিস না যেন যে মা তোর হাতের বালা
আর ব্লাউজের
মাপ জানতে চাইছে । কখনো কখনো রাগের মাথায় জিজ্ঞেস করে বসেছি , খোকা জীবনে আর কাকে কাকে ভালবেসেছ
এর আগে । কেউ কেউ হতভম্ব হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছ । তখন জিজ্ঞেস করেছি , ওহ্ , আমাকে দেখেই ইচ্ছেটা প্রথম জাগলো নাকি? কথার কোনো জবাব নেই দেখে যখন হো হো
করে হেসে উঠলাম , তখন
বোধহয় খোকার মেল ইগোতে লাগল । বলল , আমি কিন্তু কোনো অশিষ্ট আচরণ করিনি তোমার সাথে , তুমি অকারণে হেক্ল করছ আমাকে ।
তোমার আপত্তি থাকতেই পারে , কেউ
তো আর জবরদস্তি করতে যাচ্ছে না । আমি বললাম , ওহ্ , রাগ হল বুঝি ? আমাকে যে হেক্ল হতে হচ্ছে , সেটা খেয়াল করেছ ? ।
ছেলেটা যেন আকাশ থেকে
পড়ল । হেক্ল করলাম তোমাকে ? আমি
?
। আশ্চর্য তো ! কী
বললাম তোমাকে ?
-- ভালবাসার প্রস্তাব করলে তো? করোনি ?
-- হ্যাঁ, তা করেছি । তোমাকে ভাল লেগেছিল , তাই জানিয়েছি সে কথা । এতে অন্যায় কোথায় ? তোমার সাথে পরিচয় আছে , বন্ধুত্ব আছে , অনেক রকম গল্প , আলোচনা হয়েছে এ যাবৎ । একটা সহজ
সম্পর্ক আছে বলে এত স্পষ্ট করে বলতে পেরেছি । এতে অন্যায় কোথায় ? এতে তোমায় হেক্ল করা হল কেমন করে ?
-- নয় হেক্ল করা? এতটা সহজ সম্পর্ক নিশ্চয় আরো
অনেকের সাথে তৈরি হয়েছে, অনেক
ছেলে বন্ধুদের সাথে ? তাদের
কাউকে কি এমন কায়দা করে কখনো বলতে গিয়েছ , " ভালবাসি " । জানি , বলোনি কখনো। কারণ তারা ছেলে , তাদের নিয়ে কোনো বিশেষ সম্পর্কের
কথা ভাবা যায় না । আমায় শুনতে হল কারণ আমি মেয়ে । আমি মেয়ে বলে একের পর এক ছেলেরা
এসে ইনডাইরেক্টলি তাদের সেই বিশেষ ইচ্ছের কথা শুনিয়ে যাবে আর আমাকে কিনা বিনা রাগে
হাসিমুখে শুনতে হবে সেগুলো ? সেটা
হেক্লড হওয়া নয় ? ।
তখন থামল ছেলেটা । তারপর "ঠিক আছে , আসছি " বলে যখন চলে যাচ্ছে , তখন পিছন ডেকে বললাম , শোনো , কাল থেকে কথা বন্ধ করে দেবে এমন
যেন না হয় । দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে না-চেনার ভান করে , এমন দেখলে কিন্তু সব ফাঁস করে দেব , বুঝলে । এতক্ষণ পর প্রথম হাসল
ছেলেটা । বলল , না
,
না , তা হবে না কখনো ।
একমনে শুনছিল সমীর ।
এতক্ষণে তার লজ্জা পাওয়ার ভাব কেটে গেছে অনেকটাই । জিজ্ঞেস করল " তোমাদের
ইয়ারের ?
-- কে ? ছেলেটা ?
-- হ্যাঁ , তা না হলে আর কার কথা বলব ?
-- বুঝেছি , কিন্তু তা যে বলতে পারব না সমীরদা
। অলিখিত চুক্তি আছে যে , কাউকে
জানাব না ।
-- ওহ্ ।
ঠিক এই সময় কেবিনের
পর্দা সরে গেল । চোখ সরে গেল দুজনেরই সেই দিকে । বেয়ারার হাতে ট্রে । তার উপর
কয়েকখানা প্লেট । ধোঁয়া উঠছে প্লেট থেকে । প্লেটগুলো এক এক করে নামিয়ে দেওয়া হল
টেবিলের উপর । সমীর আর তন্দ্রার আলাপচারিতায় সামান্য বিরতি তখন । বেয়ারা তখনো
কেবিনের মধ্যে প্লেট সাজাচ্ছে , তারই
সামনে স্যালাডের প্লেটটা টেনে নিয়ে কচ কচ করে পেঁয়াজ চিবোতে লাগল তন্দ্রা । সমীর
ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল , আরে
,
খাবার ফেলে স্যালাড
চিবোচ্ছে যে ! স্যালাড এত ভালবাসো ?
-- স্যালাড না, পেঁয়াজ ।
বলেই বেয়ারাকে বলল, ভাই একটু রসুন এনে দিতে পারবে? এক কোয়া হলেই হবে । আর একটা
কাচালঙ্কা । বেয়ারা বলল , " রসুন
কোথায় পাব ? স্যালাডে
রসুন থাকে না । লঙ্কা চাইলে আরো এনে দিচ্ছি "। কিন্তু তন্দ্রার নাছোড় আবদার । বলল
,
দাও না ভাই এনে , রসুন না হলে আমি খেতে পারি না ।
কিচেনে গেলে পাবে । এত কিছু প্রিপারেশন হচ্ছে , রসুন না থেকে পারে ? । বেয়ারা বলল , ঠিক আছে দেখছি , রান্নার জন্যে আনা রসুন ওরা দেয়
কিনা । তন্দ্রা বলল , ঠিক
আছে আমি এক্সট্রা পেমেন্ট করছি তার জন্য । অন্য রেস্টুরেন্টে তো চাইলে দেয় ।
অবাক হয়ে দেখছিল সমীর ।
বেয়ারা চলে যাওয়ার পর হাসতে হাসতে বলল , এমন তো দেখিনি কখনো , রসুনের জন্য কাউকে এমন বায়না ধরতে
! রসুন আবার কেউ শখ করে খায় নাকি ? মুখে গন্ধ হয় , আশেপাশে কেউ বসতে পারে না ।
তন্দ্রাও হাসল। বলল , ঠিক বলেছ সমীরদা , বিশ্রী গন্ধ হয় মুখে , অনেকক্ষণ পর্যন্ত যায় না । নিরুপায়
হয়ে খাওয়া , এখন
অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ।
-- নিরুপায় হয়ে কেন ? ডাক্তার বলেছে ?
'-- না , না , একটা বিদেশি ম্যাগাজিনে পড়েছি ।
সেই থেকে খাচ্ছি ।
-- রসুনের তো উপকারিতা
আছেই । সে তো আমরা এমনিই জানি , তার
জন্য বিদেশি ম্যাগাজিন পড়তে হবে কেন ? সেখানে কি আর কোনো উপকারিতার কথা লিখেছে ?
-- হ্যাঁ , লিখেছে । কিন্তু তা তেমন বলবার মত
নয় ।
-- তবু শুনিই না কী লিখেছে
।
-- লিখেছে ওর গন্ধের কথা
আর সেই গন্ধ কেমন কাজ দেয় ।
-- যেমন ?
-- লিখেছে হলিউডের কিছু
নাক উঁচু হিরোইনরা নাকি অভিনয়ের সময় সেটে ঢুকবার আগে খুব করে পেঁয়াজ আর রসুন
চিবিয়ে নেয় , যাতে
চুম্বন দৃশ্যে হিরোরা অকারণে বেশি সময় ঠোঁটের উপর ঠোঁট ঠেকিয়ে রাখতে না পারে , যাতে ছিটকে সরে যায় । ভেবে দেখলাম
প্রোটেকশন মেজার হিসাবে ব্যাপারটা খারাপ নয়। সাধারণ মেয়েরাও তা করতে পারে যদি
কখনো বোঝে তেমন আশঙ্কা আছে ।
শেষের কথাটা শোনা
মাত্রই মুখটা কালো হয়ে গেল সমীরের । উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল সে । একটু এগিয়ে গিয়ে এক
টানে পর্দাটা সরিয়ে দিল । অমনি যেন বাইরের আলোর সাথে বাইরের সব কিছু কেবিনের মধ্যে
ঢুকে পড়ল । খদ্দের কেউ নেই , কেবল
একজন দূরে এক কোনে মাথা নিচু করে বসে চা খাচ্ছে । চা , শুধুই চা । সমীর বলল , কাউকে তো দেখছি না বাইরে । সে
ছেলেটা রসুন খুঁজতে দেশান্তরী হল নাকি ? খেয়ে নাও , খেয়ে নাও , কতক্ষণ আর বসে থাকবে ? রসুন নিয়ে সে আর আসবে না ।
হাতে তখন ছুরি আর কাঁটা
চামচ ধরল তন্দ্রা । তারপর মুখ তুলে সমীরের চোখের উপর চোখ রেখে বলল , কী যেন বলবে বলছিলে ? কই , সেই কথাটাই তো বললে না এখনও ।
-- আর কী বলব , তোমার কি আর কোনো কথা জানতে বাকি
আছে নাকি ? অনুমানে
তো তুমি সব কথাই ঠিক ঠিক জেনে যাও। তখন তো বললেই যে আমার কথাই নাকি আমি আগেই সব
বলে দিয়েছি , তুমি
শুনতে পেয়েছ । শুধু সন্দেহ নিরসনের বাকি ছিল যে ঠিক শুনেছ কিনা । এখন মনে হয় সে
সন্দেহ নিরসন হতে বাকি নেই ।
-- বাকি থাকবে না কেন ? তোমার মুখ থেকে না-শোনা পর্যন্ত
বাকি তো থাকবেই ।
শুনে কেবল হাসল সমীর , ধনুকের মতন বাঁকা সেই হাসি ।
তন্দ্রা বলল , হাসছ
যে ? সমীর
বলল , হাসছি
তোমার অনুমানের আলস্য দেখে । মাথা খাটাও , দেখবে যে বলার আর বাকি নেই । যা
বলার সব বলে দিয়েছি । এই প্রথম তন্দ্রাকে গম্ভীর দেখাল । সমীর বলল , একটু বসো তো , বাইরে গিয়ে দেখে আসি ছেলেটা গেল
কোথায় , এক
কোয়া রসুন এখনও জোটাতে পারল না । তন্দ্রা বলল , থাক , লাগবে না ।
-- না না , তা হয় নাকি ? বড় মুখ করে বললে , আর আমি কিনা এক কোয়া রসুনের
ব্যবস্থা করতে পারব না তোমার জন্য ? এখানে না পাই , বাইরে কোনো দোকানে তো পাব ।