বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ছোট গল্প “ফাঁসুড়ে ডাকাত” অবলম্বনে।
ফাঁসুড়ে ডাকাত
অলোক চৌধুরী
তখন আমার বাইশ বছর বোধ হয়,
আমি
তখন মাদুলির ফেরিওয়ালা।
কবিরাজের কাছে চাকরি করে,
ঘুচিয়ে
ছিলাম সংসারেরই জ্বালা।।
সাত্ত্বিক বামুন সাজতে হতো আমায়,
গেরিমাটিতে
ছোপানো কাপড় পরে।
পায়ে থাকতো ক্যাম্বিসেরই জুতো,
রুদ্রাক্ষের
মালা ধারণ করে।।
বছর তিনেক সেই চাকরি করি,
ছেড়ে
দিলাম ধকল সইল না।
ছাড়ার আগে গিয়েছিলাম এক গ্রামে,
আদায়
করতে না দেওয়া পাওনা।।
বর্ধমানের মাখনপুরে যেতে,
মেমারী
থেকে হাঁটার রাস্তা ধরি।
রাস্তায় কিছু উদর পূর্তি করে,
যেতে
হবে সেথায় তাড়াতাড়ি।।
শুনে সবাই ভয় দেখিয়ে বলে,
ঠাকুরমশাই
যাবেন না গো হোথা।
ফাঁসুড়ে ডাকাত ঘাপটি মেরে থাকে,
শরীর থেকে কেটে নেবে মাথা।।
তবু আমায় যেতেই হবে সেথা,
বারণ আমি তাদের নাহি শুনি।
সন্ধ্যেবেলায় এক দিঘির কাছে এসে,
একা আমি মনে প্রমাদ গুনি।।
খুব বড় সেকেলেএক দিঘি,
দুই পারেতেই তালগাছের সারি।
ডাকাত যদি আসে আমার কাছে,
উল্টো দিকেও দৌড় দিতে পারি।।
দূরে দেখি লিলি করছে গ্রাম,
ওই গ্রামটাই খুঁজছি আমি যাকে।
ওটা নিশ্চই সেই সঞ্জয়পুর,
কি ভয়টাই না দেখিয়েছিল লোকে।।
তখন আমার এটাই মনে হল,
মানুষ কেন মিথ্যে দেখায় ভয়।
যেসব কথা বলেছিল ওরা,
এসে দেখি তেমন কিছুই নয়।।
হটাৎ দেখি এক বৃদ্ধ পিছন পানে,
আমার দিকেই আসছে মনে হয়।
হাত নেড়ে সে আমায় যেন ডাকে,
কাছে এসে বললে সে আমায়।।
সাঁঝেরবেলা যাবেন আপনি কোথা,
রাতের বেলায় একটু বিশ্রাম নিতে।
চলুন না তবে আমার বাড়ির পানে,
চলুন না তবে আমার বাড়ির পানে,
যেথায় যাবেন পৌঁছে দেব প্রাতে।।
অসুবিধা কিছুই রাখব না যে,
চাল ডাল সব মজুত ঘরেতেই।
একটু খানি পুণ্যি করার লোভে,
বামুন সেবা করে ধন্য হই।।
মনে হলো ভালোই হলো আমার,
ভগবান তো আছেই আমার সাথে।
বৃদ্ধের নাম নফর চন্দ্র দাশ,
উঠলাম গিয়ে এক চণ্ডী মণ্ডপেতে।।
ভগবান তো আছেই আমার সাথে।
বৃদ্ধের নাম নফর চন্দ্র দাশ,
উঠলাম গিয়ে এক চণ্ডী মণ্ডপেতে।।
এক নাগাড়ে হটাৎ কুকুর ডাকে,
কেমন যেন অমঙ্গলময়।
কেমন যেন অমঙ্গলময়।
মনে হলো এলাম শশ্মানভূমে,
এটা কোন গৃহস্থবাড়ি নয়।।
পরে দেখি বেশ অবস্থাপন্ন তিনি,
বাড়ির মধ্যে তিনটে ধানের গোলা।
গোয়ালঘরে আছে কত গরু,
বাড়ির মধ্যে চারটে আটচালা।।
এটা কোন গৃহস্থবাড়ি নয়।।
পরে দেখি বেশ অবস্থাপন্ন তিনি,
বাড়ির মধ্যে তিনটে ধানের গোলা।
গোয়ালঘরে আছে কত গরু,
বাড়ির মধ্যে চারটে আটচালা।।
সেইখানেতে একটা ছোট্টঘরে,
থাকতে দিল আমায় যতন করে।
চাল,
ডাল,
জল এনে দিল সবই,
বলল, স্বপাক রান্না নেবেন করে।।
বলল, স্বপাক রান্না নেবেন করে।।
খানিক পরে সমুখ পানে দেখি,
ঝাঁটা হাতে আসছে একটি মেয়ে।
মনে হলো বাড়িরই কোন বউ,
ঝাঁটা হাতে আসছে একটি মেয়ে।
মনে হলো বাড়িরই কোন বউ,
সামনে এসে চকিতে তাকাল চেয়ে।।
অপলকে তাকিয়ে আমার পানে,
ভাল লাগে না গণ্ডগ্রামে এসে।
ব্যাপারটা মোর লাগছে না তো ভালো,
ঝামেলায় কি পড়ব অবশেষে।।
ব্যাপারটা মোর লাগছে না তো ভালো,
ঝামেলায় কি পড়ব অবশেষে।।
খানিকবাদে উঠান ঝাঁটা দিয়ে,
চলে গেল ভিতর বাড়ির দিকে।
আমার পানে চায় যে ফিরে ফিরে,
ভাবি আমি, বলবে যা তা লোকে।।
আমার পানে চায় যে ফিরে ফিরে,
ভাবি আমি, বলবে যা তা লোকে।।
মিনিট পাঁচেক পরেই আবার এলো,
মনে হল সে খুবই উত্তেজিত।
নীচুস্বরে বললে আমার পানে,
আজ আপনার মৃত্যু নির্দ্ধারিত।।
মনে হল সে খুবই উত্তেজিত।
নীচুস্বরে বললে আমার পানে,
আজ আপনার মৃত্যু নির্দ্ধারিত।।
এরা হল ফাঁসুড়ে ডাকাত সব,
এখান থেকে পালান সুযোগ পেলে।
চকিতে সে চলে গেল কোথা,
আচম্বিতে আমায় এ সব বলে।।
এখান থেকে পালান সুযোগ পেলে।
চকিতে সে চলে গেল কোথা,
আচম্বিতে আমায় এ সব বলে।।
শুনে আমার হৃদকম্প শুরু,
খুন্তি আমার রয়েই গেল হাতে।
ভাবি গৃহস্থরা ডাকাত অবশেষে,
জীবন আমার শেষ হবে এই রাতে।।
খুন্তি আমার রয়েই গেল হাতে।
ভাবি গৃহস্থরা ডাকাত অবশেষে,
জীবন আমার শেষ হবে এই রাতে।।
কি করেই বা পালাব এখান থেকে,
জানিনা তো গ্রামের কোন কিছু।
জানিনা তো গ্রামের কোন কিছু।
ছেলেদের নিয়ে বৃদ্ধ দাওয়ায় বসে,
পালাতে গেলেই করবে কেটে কচু।।
মিনিট পাঁচেক পরেই বউটি আসে,
মনে ভাবি, দয়াময়ী ওগো তুমি।
দাওনা বলে পালাব কিভাবে যে,
কি যে হবে জানেন অন্তর্যামী।।
কি যে হবে জানেন অন্তর্যামী।।
বউটি বলে, দেখে এলাম সব,
পালাবার তো কোন উপায় নাই।
ঘাঁটি আগলে বসে আছে ওরা,
পালাবার তো কোন উপায় নাই।
ঘাঁটি আগলে বসে আছে ওরা,
অন্য কিছু ভাবতে হবে তাই।।
তবে একটা উপায় এখনও দেখি আছে,
যদি তাতে কিছুটা কাজ হয়।
যদি তাতে কিছুটা কাজ হয়।
ব্রহ্মহত্যা হয়েছে অনেক হেথা,
বন্ধ এবার করবই তা নিশ্চয়।।
বন্ধ এবার করবই তা নিশ্চয়।।
মনে রাখুন আমার ক’টা কথা,
বাঁচার রাস্তা আছে ওই একটাই।
বাঁচার রাস্তা আছে ওই একটাই।
বলতে যদি পারেন ঠিক মতো,
অভিনয়টাও করতে পারা চাই।।
আমার নাম বামা, বাড়ির মেজবউ,
হরিদাস আমার বাবার নাম।
অভিনয়টাও করতে পারা চাই।।
আমার নাম বামা, বাড়ির মেজবউ,
হরিদাস আমার বাবার নাম।
বাপের বাড়ি আমার কুসুমপুর।
আপনারও বাস আমাদের সেই গ্রাম।।
আমরা হলাম দুটি মাত্র বোন,
ক্ষান্তমণি আমার দিদির নাম।
তার শ্বশুরের নাম দুর্লভ দাস,
সামতাপুর, তেওটা বর্দ্ধমান।।
ক্ষান্তমণি আমার দিদির নাম।
তার শ্বশুরের নাম দুর্লভ দাস,
সামতাপুর, তেওটা বর্দ্ধমান।।
জাতে আমরা সবাই বারুই,
আমার বাবা এখনও আছে বেঁচে।
মা মারা গেছেন আমার ছোটবেলায়,
আমার বাবা এখনও আছে বেঁচে।
মা মারা গেছেন আমার ছোটবেলায়,
জ্যাঠামশাই এখনও সাথেই আছে।।
বলবেন আপনি তাদের গুরুবংশ,
তখন যেন কাঁপে না এই গলা।
সন্দেহ যেন না হয় কোন মতে,
তাহলে আপনার শেষ হবে ভবখেলা।।
তখন যেন কাঁপে না এই গলা।
সন্দেহ যেন না হয় কোন মতে,
তাহলে আপনার শেষ হবে ভবখেলা।।
ভয় পাবেন না গুরু ঠাকুরমশাই,
রান্না খাওয়া এবারে সেরে নিন।
রান্না খাওয়া এবারে সেরে নিন।
তারপরেতে শ্বশুরের কাছে গিয়ে,
আপনার এই পরিচয়টা দিন।।
আপনার এই পরিচয়টা দিন।।
খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে আমি,
নিজের মনে বারেক ঝালিয়ে যাই।
ভুলটি যদি কিছু বলে ফেলি,
সাঙ্গ হবে সাধের জীবনটাই।।
নিজের মনে বারেক ঝালিয়ে যাই।
ভুলটি যদি কিছু বলে ফেলি,
সাঙ্গ হবে সাধের জীবনটাই।।
হটাৎ দেখি সামনে গৃহস্বামী,
দাঁড়ায় এসে দরজাখানি খুলে।
ঠাকুরমশাই নিন পানটা খান,
গৃহস্বামী হেসে আমায় বলে।।
গৃহস্বামী হেসে আমায় বলে।।
সামনে পেয়ে শুধাই আমি তারে,
একটা কথা আপনাকে আমি কই।
আমার এক মন্ত্রশিষ্য আছে,
বাস তাহার এই সঞ্জয়পুরেতেই।।
একটা কথা আপনাকে আমি কই।
আমার এক মন্ত্রশিষ্য আছে,
বাস তাহার এই সঞ্জয়পুরেতেই।।
হরিদাস নামটি তাহার,
ছোট মেয়ের নাম বামা।
ছোট মেয়ের নাম বামা।
এখানে কোথাও হয়েছে তাহার বিয়ে,
আছে নাকি আপনার তা জানা।।
আছে নাকি আপনার তা জানা।।
বলে ছিল হেথায় আসার সময়,
ঘুরে আসতে তাদের বাড়ি থেকে।
ঘুরে আসতে তাদের বাড়ি থেকে।
কাল সকালে সেথায় যাব আমি,
চেনে তাদের গ্রামের সর্বলোকে।।
আমার কথা শুনে গৃহস্বামী,
অবাক হয়ে আমার পানে চায়।
সত্যি করে আপনি তাদের চেনেন,
দয়া করে বলুন তা সব আমায়।।
অবাক হয়ে আমার পানে চায়।
সত্যি করে আপনি তাদের চেনেন,
দয়া করে বলুন তা সব আমায়।।
বামার কথা মনে স্মরণ করি,
দৃঢ়স্বরে বলি তাদের আবার।
আমি হলেম তাদের গুরুবংশ,
মন্ত্রশিষ্য তারা আমার বাবার।।
দৃঢ়স্বরে বলি তাদের আবার।
আমি হলেম তাদের গুরুবংশ,
মন্ত্রশিষ্য তারা আমার বাবার।।
বৃদ্ধ বলেন, দাদাঠাকুর, একটু বসুন,
ভিতর থেকে আসছি আমি ঘুরে।
ভিতর থেকে আসছি আমি ঘুরে।
ভয় তখনও যায়নি পুরো আমার,
রেহাই পাবো আমি কি এরপরে।।
রেহাই পাবো আমি কি এরপরে।।
বেশ কিছুক্ষণ পরে গৃহস্বামী,
আমার কাছে আবার ফিরে আসে।
পিছে আসে বাড়ির সব লোক,
বামাও দেখি আসে সবার শেষে।।
আমার কাছে আবার ফিরে আসে।
পিছে আসে বাড়ির সব লোক,
বামাও দেখি আসে সবার শেষে।।
পরিচয় দেয় এক এক করে সবার,
সবাই এসে আমায় গড় করে।
বামাও আসে ধীর পায়ে শেষে,
চোখের জলে পা-টি আমার ভরে।।
সবাই এসে আমায় গড় করে।
বামাও আসে ধীর পায়ে শেষে,
চোখের জলে পা-টি আমার ভরে।।
আমারও চোখ অশ্রুজলে ভাসে,
দয়াময়ী তুমি আমার বামা।
তুমি যদি থাকতে নাকো হেথা,
জীবন আমার যেত, তা তো জানা।।
দয়াময়ী তুমি আমার বামা।
তুমি যদি থাকতে নাকো হেথা,
জীবন আমার যেত, তা তো জানা।।
সকাল হলে আমার যাবার কালে,
সপরিবার গৃহস্বামী আসে।
পাঁচটি টাকা গুরুপ্রণামী দেয়,
শান্ত মুখে আশীর্বাদের শেষে।।
সপরিবার গৃহস্বামী আসে।
পাঁচটি টাকা গুরুপ্রণামী দেয়,
শান্ত মুখে আশীর্বাদের শেষে।।
বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফাঁসুড়ে ডাকাত গল্পের একটি অসাধারন কাব্যরূপ দিয়েছেন আমাদের সবার প্রিয় অলোক চৌধুরী। কবিতাটি ভারী মর্মস্পর্শী হয়েছে,মূল গল্পটির সাহিত্য-রস অক্ষুণ্ণ রেখে।
উত্তরমুছুনআশা করি সবার ভালো লাগবে এই কবিতাটি। সঙ্গের ছবিটিও পত্রিকার সব ছবির মতই অলোকদাদার আঁকা ও যথারীতি প্রাসঙ্গিক ।
বিভূতিভূষন এর গল্পের কাব্যরূপটি বেশ চমৎকার হয়েছে। কিন্তু গল্পের "দয়াময়ী" যে নিজেই গভীর বিপদের মধ্যে রয়েছে সে কথা কেউ ভেবে দেখেছেন কি?
উত্তরমুছুনঅসাধারণ অলক দা !! পড়তে পড়তে বালক হয়ে গেলাম ! মাঝে শুধু তিনটে হোঁচট খেলাম ! দীর্ঘ যাত্রা পথে, হঠাৎ করে হটাৎ হল দুবার !! মানুষ পেলে ভয়, শ্মশানভূমে কি করে যেন, শশ্মানভূমে হয় !!
উত্তরমুছুনসত্যিই অসাধারণ । কী করে লিখলেন দাদা ! কতক্ষণ লেগেছে লিখতে ? এর পরে কোনটা লিখবেন ঠিক করেছেন ? সুকুমার রায়ের " রাগের ওষুধ " টা কাব্যরূপে লিখে দেন দাদা, হেব্বি হবে !
উত্তরমুছুন